ঋণ আর দারিদ্র কেঁড়ে নিল এক পরিবারের ৪ জনের প্রাণ - সময় আমাদের (somoy amader)

শিরোনাম


Friday, 15 August 2025

ঋণ আর দারিদ্র কেঁড়ে নিল এক পরিবারের ৪ জনের প্রাণ


সময় ডেস্ক : রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বামুনশিকড় গ্রামে চাঞ্চল্যকর এক ঘটনায় একই পরিবারের চারজনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শুক্রবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে বিষয়টি জানাজানি হয়, পরে দুপুরে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃতরা হলেন মিনারুল ইসলাম (৩৫), তাঁর স্ত্রী মনিরা বেগম (২৮), ছেলে মাহিন (১৩) ও মেয়ে মিথিলা (২)। মাহিন স্থানীয় খড়খড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল এবং মিনারুল কৃষিকাজ করতেন।


পুলিশ, স্থানীয় ও পরিবারের সদস্যদের বরাতে জানা গেছে, মিনারুল দীর্ঘদিন ধরে ঋণগ্রস্ত ছিলেন। একসময় জুয়া খেললেও পরে তা ছেড়ে দেন। দেড় বছর আগে তাঁর বাবা রুস্তম আলী ধানিজমি বিক্রি করে দেড় লাখ টাকা দিয়ে ঋণের একটি অংশ পরিশোধ করেন। কিন্তু বাকি দুই লাখ টাকার ঋণ রয়ে যায়। প্রতি সপ্তাহে তাঁকে ২ হাজার ৭০০ টাকার বেশি কিস্তি পরিশোধ করতে হতো, যা তিনি সম্প্রতি আর চালাতে পারছিলেন না। বাবাকে জমি বিক্রি করে ঋণ শোধ করার অনুরোধ করলেও রাজি না হওয়ায় বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন মিনারুল। এমনকি সন্তানদেরও তাঁদের সঙ্গে মিশতে দিতেন না।


শুক্রবার সকালে মিনারুলের বাবা স্থানীয় হাট থেকে মাছ কিনে আনেন এবং নাতনি মিথিলাকে ডাকতে যান দাদি আঞ্জুয়ারা বেগম। বারবার ডাকাডাকির পরও কোনো সাড়া না পেয়ে পাশের ঘরে গিয়ে দেখেন, মিনারুল সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছেন।


খবর পেয়ে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন এবং স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সাহেদ আলীকে জানান। পরে পুলিশ এসে ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে।


ঘরটি ‘এল’ আকৃতির চার কক্ষবিশিষ্ট। পশ্চিম দিকের প্রথম ঘরে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় মিনারুলের মরদেহ পাওয়া যায়, বিছানায় পড়ে ছিল ছেলে মাহিনের দেহ। তাঁর গলার পাশে একটি গামছা পাওয়া যায়। সেখানেই পাওয়া যায় দুই পৃষ্ঠার একটি হাতে লেখা চিরকুট। ভেতরের পরের কক্ষে স্ত্রী মনিরা বেগম ও মেয়ে মিথিলার মরদেহ পাওয়া যায়। স্ত্রীর গলার পাশে মোবাইল চার্জারের তার ছিল।


রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মিনারুল প্রথমে স্ত্রী ও সন্তানদের শ্বাসরোধে হত্যা করে পরে আত্মহত্যা করেছেন। মরদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে এবং এ ঘটনায় মামলা হবে। ঘটনাস্থল থেকে সিআইডি ও পিবিআই আলামত সংগ্রহ করেছে।


চিরকুটে লেখা ছিল- ‘আমরা চারজন পৃথিবী থেকে বিদায় নেব, আর দেখা হবে না খোদা হাফেজ। আমি মিনারুল। নিচে যেসব লেখা লিখব, সব আমার নিজের কথা, এই কারণে লিখে যাচ্ছি, কারণ, আজ রাতে আমরা চারজন মারা যাব। এই মরার জন্য কারও কোনো দোষ নেই। কারণ লিখে না গেলে পুলিশ কাকে না কাকে ফাঁসিয়ে টাকা খাবে। আমি মিনারুল প্রথমে আমার বউকে মেরেছি। তারপর আমার মাহিনকে মেরেছি। তারপর আমার মিথিলাকে মেরেছি। তারপর আমি গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছি। আমাদের চারজনের মরা মুখ যেন বাপের বড় ছেলে ও তার বউ–বাচ্চা না দেখে এবং বড় ছেলে যেন জানাজায় না যায়। আমাদের চারজনকে কাফন দিয়ে ঢাকতে আমার বাবা যেন টাকা না দেয়। এটা আমার কসম। (ইতি মিনারুল, আসসালামু আলাইকুম)।’


‘আমি নিজ হাতে সবাইকে মারলাম এই কারণে যে আমি একা যদি মরে যাই, তাহলে আমার বউ, ছেলেমেয়ে কার আশায় বেঁচে থাকবে। কষ্ট আর দুঃখ ছাড়া দিতেই পারব না। আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না। তাই আমাদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম, সেই ভালো হলো। কারও কাছে কিছু চাইতে হবে না। আমার জন্য কাউকে মানুষের কাছে ছোট হতে হবে না। আমার বাবা আমার জন্য অনেক লোকের কাছে ছোট হয়েছে। আর হতে হবে না। চিরদিনের জন্য চলে গেলাম। আমি চাই, সবাই ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।’


স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেদ আলী জানান, মিনারুল বর্ষাকালে কাজের অভাবে চাপে ছিলেন। তিন দিন আগে তাঁর কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে চাল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনেছিলেন। একসময় জুয়া খেললেও পরে তা ছেড়ে দেন। ঋণের কিছুটা পরিশোধ করলেও অবশিষ্ট টানতে না পেরে হতাশায় ভুগছিলেন।


ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসী, আত্মীয়-স্বজন ও গণমাধ্যমকর্মীরা বাড়িতে ভিড় করেন। সবার মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া, শুরু হয় কান্না ও আহাজারি।


পুলিশ বলছে, তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।



No comments:

Post a Comment

Pages